সেই সব সুন্দরী মোহনীয় কন্যাদের সে একজন, ভাগ্যের পরিহাসে যার জন্ম হয়েছে কাঠমিস্ত্রির ঘরে। বিয়ে নিয়ে ভাবনা তার ছিলো না মোটেই, প্রত্যাশাও ছিলো না তেমন। সবাই তাকে জানবে-চিনবে-বুঝবে-ভালোবাসবে, আর ধন-মানে বড় কেউ হবে তার জীবনসঙ্গী এমনটা হবার নয় বলে সে-ও জানতো। তাই শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ছাপোষা এক
কেরাণির সঙ্গে বিয়েটা যখন হয়ে গেলো তখন কোনো ওজর-আপত্তি করেনি। তার রুচি সাধারণ মানের, কারণ ভালো কিছু পাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। তবে মনোকষ্ট ছিলো একটা ভেতরে ভেতরে। মন বলতো, এর চেয়ে একটা ভালো বিয়ে তার হতেই পারতো। সে নিজেও নয় কোনো বড় ঘরের মেয়ে। সৌন্দর্য্য বা আকর্ষণ যেটুকু তাও জন্ম কিংবা পরিবার সূত্রে পাওয়া। কমনীয় মুখ, মার্জিত ভাব আর বুদ্ধির ছটা তাতে রয়েছে। আর সে জানে ওটুকু থাকলে বস্তির মেয়েটিও হয়ে উঠতে পারে দেশের সবচেয়ে সেরা নারীদের একজন। কষ্টের তার অন্ত ছিলো না। কেবলই মনে হতো, আহা! জন্ম যদি হতো কোনও অভিজাত ঘরে, বিলাসিতার মাঝে। আর তাই পরতে পরতে দারিদ্র ছড়িয়ে থাকা ঘরটি তাকে বেশ কষ্ট দেয়। নোংরা দেয়াল, ভাঙা চেয়ার, শ্রীহীন পর্দাগুলো দেখে একটুও ভালো লাগে না। তার শ্রেণির অন্য নারীরা এতেই অভ্যস্ত, সামান্য ভাবনাটুকুও তাদের নেই, অথচ এসবই তাকে দমিয়ে রাখে, অপমানবোধ তাকে রাখে ন্যুব্জ করে। যে ছোট্ট মেয়েটি তার ঘরে কাজ করতে আসে ওকে দেখলেই তার ভিতরে এক ধরনের হৃদয়ভাঙ্গা দুঃখবোধ জেগে ওঠে। আর মনের ভেতর ভাসতে থাকে আশাহত স্বপ্নগুলো। কল্পনা জুড়ে তার ছোট্ট একটি নিরিবিলি ঘর, পরিধানে প্রাচ্যদেশীয় কারুকাজ বুননে তৈরি তাপিশী, ব্রঞ্জের চমৎকার সকেটে লটকে থেকে বাতিগুলো ছড়াবে মৃদু আলো, দুই ঢ্যাঙা লম্বালোক হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে পাহাড়ায় আর সে বড় হাতলওয়ালা চেয়ারে থাকবে ঘুমিয়ে, স্টোভের আভা থেকে সে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে উপভোগ্য উষ্ণতা। তার কল্পনায় বড় আলনায় রেশমি কাপড়গুলো ঝুলে থাকে, দামী, অভিজাত নিঁখুত আসবাব, অমূল্য গহনা-গাঁটি, আর ছোট্ট মোহনীয় সুগন্ধিভরা কামরা যেখানে কেবল অতি কাছের সখীদের গতায়ত চলে। আসতে পারে সেইসব কাঙ্খিত পুরুষও, যাদের জন্য যে কোনও নারীরই থাকে অপেক্ষা।

তিন দিনের পুরোনো কাপড়ে ঢাকা গোল টেবিলখানায় যখন রাতের খাবার নিয়ে বসে, উল্টোদিকে বসেন তার স্বামী। আর স্যুপের পাত্র থেকে ঢাকনাটা তুলতে তুলতে আনন্দমাখা কণ্ঠে বলে ওঠেন: “আহা! স্কচ ব্রোথ! এর চেয়ে ভালো আর কিই হতে পারে?” তখন তার ভাবনা জুড়ে উপাদেয় সব খাবার, রুপার চকচকে থালা-বাটি, দেয়ালে ঝোলানো তাপিশীর গায়ে রুপকথার বনে উড়ে বেড়ানো অদ্ভুত সুন্দর পাখিদের ঝাঁক; তার কল্পনায় ভাসে মনোমুগ্ধকর পাত্রে তুলে দেওয়া খাবার, চামচ-প্লেটের টুং-টাং আর স্মিত হাসিতে অ্যাসপারাগাসে রান্না মুরগীর পাখনা থেকে মাংস ছড়াতে ব্যস্ত সে।

তার একটি সুন্দর কাপড় নেই, গহণা নেই, কিচ্ছু নেই। অথচ এসব কিছুতেই তার ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে। তার মনে হয়, ওসব কিছু পাওয়ার জন্যই তার জন্ম। প্রগাঢ় আকাঙ্খা নিয়ে সেই মোহনীয়তারই অপেক্ষা তার। মনে ভাবে, সেই হবে কাঙ্খিত, বন্য আকর্ষণে তাকেই চাইবে সবাই।

কিছু ধনী বন্ধু তারও আছে। স্কুলের পুরোনো বন্ধু। ওদের বাড়িতে যেতে মন ওঠে না। গেলেই ভীষণ কষ্টবোধে তাকে জেঁকে ধরে। আর ঘরে ফিরে আসে। অতঃপর প্রচণ্ড মর্মপীড়া, দুঃখ, হতাশা আর যন্ত্রণায় ডুবে থেকে দিনভর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।

এক সন্ধ্যায় তার স্বামী ঘরে ফিরলেন ফুরফুরে মেজাজে। হাতে তার একটি খাম। “এর মধ্যে তোমার জন্য একটি দারুণ জিনিষ আছে,” কণ্ঠে উচ্ছ্বাস তার। দ্রুত স্বামীর হাত থেকে খামটা নিয়ে ছিঁড়ে একটি ছাপানো কার্ড বের করে আনলো সে। তাতে লেখা: “শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাদাম রামপোন্যু আগামী ১৮ জানুয়ারি সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানে অত্যন্ত আনন্দচিত্তে মঁসিয়ে ও মাদাম লোইজেলের সান্নিধ্য কামনা করছেন।”

স্বামীর প্রত্যাশা ছিলো খুশিই হবে তার স্ত্রী। কিন্তু তার বদলে, অবজ্ঞাভরে সে আমন্ত্রণপত্রটি টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলো। আর বললো:“এটা দিয়ে আমি কী করবো?” “কেনো, প্রিয়তম, আমিতো ভেবেছিলাম তুমি খুশিই হবে। কখনো বাইরে যেতে পাও না। এটা বেশ বড়মাপের অনুষ্ঠান। অনেক ঝক্কি করে তবেই দাওয়াতটা বাগিয়ে নিয়েছি। সবাই এমন একটি দাওয়াত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। খুব বেছে বেছে ওরা আমন্ত্রণ জানায়। কেরাণিদের ভাগ্যে খুব কমই জোটে। ওখানে গেলে তুমি সব বড় বড় লোকেদেরই দেখতে পাবে।” স্বামীর পানে রোষকষায়িত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে সে। আর ঝাঁঝালো কণ্ঠে ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নবাণ, “এমন একটা অনুষ্ঠানে আমি কি পরে যাবো বলো তো?” এ নিয়ে আদৌ ভাবেন নি; তাই একটু হতোদ্যমই হতে হলো বেচারা স্বামীকে। তবে বললেন: “কেনো, যেই পোশাকে তুমি থিয়েটারে যাও। ওগুলোতো আমার কাছে ভালোই লাগে...।” বলতে বলতে থমকালেন। হতচেতন স্বামী লক্ষ্য করলেন স্ত্রী তার ততক্ষণে কান্না জুড়ে দিয়েছে। বড় বড় দুই ফোটা অশ্রু চোখের কোনা থেকে বের হয়ে গণ্ডদেশ বেয়ে মুখের কাছে নেমে আসছে।‘কি হয়েছে বলো তো? আহা! কাঁদছো কেনো?,’ অসহায় উচ্চারণ তার। ভীষণ চেষ্টায় সে তার কান্নাকণ্ঠ এড়িয়ে শান্ত স্বরে, গাল মুছতে মুছতে বললো: “কিছু না। আমার আসলে এমন একটি পোশাকও নেই যা পরে পার্টিতে যেতে পারি। তুমি বরং আমন্ত্রণপত্রটা তোমার কোনও বন্ধুকে দিয়ে দাও। তার স্ত্রী নিশ্চয়ই আমার চেয়ে সেজেগুজেই পার্টিতে যেতে পারবে।”

হৃদয়খানি ভেঙ্গে যাচ্ছিলো স্বামী ভদ্রলোকের। “দেখো মাতিলদে,” শান্ত্বনামাখা স্বর তার কণ্ঠে। “একটা ভালো পোশাকের দাম আর কতই হবে? কিনে ফেললে অন্য অনুষ্ঠানেও পরতে পারবে। কি বলো?” কয়েকটা ক্ষণ চুপ করে থাকলো সে। দাম নিয়ে ভাবলো বটে, তবে এও ভেবে নিলো কত দামের মধ্যে কেনার কথা বললে তার স্বামী এক কথায় মেনে নেবেন। সতর্ক-মনা একজন কেরাণিকে বড় কোনও অংক বলে ভড়কে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে চাইছিলো না সে। অবশেষে মুখ খুললো, তবে কিছুটা ইতস্তত করেই: “আমি ঠিক জানি না, তবে মনে হয় চারশ’ ফ্রাঁয় হয়ে যাবে।”

কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো স্বামী বেচারার মুখ। ঠিক এই পরিমান অর্থই এখন তার জমানো, একটা বন্দুক কিনবে বলে ইচ্ছা ছিলো। নাঁতেরির সমতলে এই গ্রীস্মে বন্ধুদের সাথে শিকারে যাবে এমনটাই মনোস্থির করে রেখেছিলো। বন্ধুরা ওখানে প্রতি রোববারই পাখি শিকারে যায়। বিষয়টি চেপে রেখে তিনি বরং বললেন, “খুব ভালো। আমি তোমাকে চারশ’ ফ্রাঁই দেবো। সত্যিকারের একটা ভালো পোশাকই কিনবে কিন্তু!”

পার্টির দিন যত ঘনিয়ে এলো, আর মাদাম লোইজেলকে আরও দুঃখভারাক্রান্ত আর উদ্বিগ্ন মনে হতে লাগলো। তার পোশাক যদিও ততদিনে প্রস্তুত। তো এক সন্ধ্যায় তার স্বামী তাকে বললেন: “তোমার কী হয়েছে বলো তো? গত তিন দিন ধরেই দেখছি মুখটা ভার করে রয়েছো।” “কোন জড়োয়া গহনাই নেই আমার! পরার মতো একটা দামী পাথরও না! একটুও ভালো লাগছে না,” বললো সে। “ওখানে আমাকে একদম ফালতু লাগবে। তার চেয়ে বরং আমি পার্টিতে যাবো না।” “ফুল পরো,” বললেন স্বামীটি। বছরের এই সময় ফুলগুলোতো বেশ ভালো থাকে। দশ ফ্রাঁ দিয়ে তুমে অনায়াসে দুই-তিনটা তরতাজা গোলাপ পেয়ে যাবে।” কিন্তু এই প্রস্তাবে তার মন গললো না। “না... ধনী ধনী নারীদের মাঝে দৈনতার সব ছাপ নিয়ে হাজির হওয়ার মতো লজ্জার আর কিছুই হতে পারে না।” “কী যে বোকা তুমি!” বিষ্ময় ঝরলো স্বামীর কণ্ঠে। “আচ্ছা! তোমার বান্ধবী মাদাম ফরেস্তিয়ের কাছেতো যেতে পারো! তাকে বলো তোমাকে কিছু গহনা ধার দিতে। তুমি তো জানোই তার এগুলো ঢের আছে।” আনন্দে চিৎকার করে উঠলো সে। “ঠিক বলেছো। এটা তো আমার মাথায় আসেনি।” পরের দিন সে গেলো তার বান্ধবীর বাড়িতে। আর তাকে জানালো তার কষ্টের আদ্যোপান্ত। মাদাম ফরেস্তিয়ে তার সাজগোজের টেবিল থেকে একটি বড় বাক্স তুলে এনে মাদাম লোজিয়ের সামনে খুলে দিলেন। আর বললেন: “তোমার যেটা পছন্দ হয় নাও, প্রিয়!” প্রথমেই সে কিছু ব্রেসলেট দেখলো, এরপর একটি মুক্তোর নেকলেস, এরপর দেখলো স্বর্ণ ও রত্নখচিত একটি ভেনিসীয় ক্রুস যার গায়ে অনন্য কারুকাজ। ওগুলো পরে আয়নায় নিজেকে বার বার দেখে নিচ্ছিলো সে। ইতস্তত করছিলো, আর কোনওভাবেই মনস্থির করতে পারছিলো না কোনটা রেখে কোনটা নেবে। বান্ধবীকে বললো: ‘আর কিছু আছে তোমার!” “আছেই তো! নিজে বেছে নাও। আমি তো জানি না, তোমার কোনটা ভালো লাগবে।” একটি কালো সাটিনের বাক্সের ভেতর হঠাৎই সে পেয়ে গেলো চমৎকার এক হীরার নেকলেস। ওটি দেখে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। তুলে আনতে গিয়ে হাত দুখানা কাঁপছিলো তার। আলতো করে তুলে লম্বা ড্রেসের উপর দিয়েই হারখানি গলায় জড়ালো। আর নিজেকে দেখে নিজেই অভিভূত হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর অনেকটা ইতস্তত ভাব করে ভংগুর কণ্ঠে জানতে চাইলো: “তুমি কি এটা আমায় ধার দেবে? শুধু এটাই চাই, আর কিছু নয়!” “হ্যাঁ, কেনো নয়! অবশ্যই দেবো।” ছুটে গিয়ে বন্ধুর বুকে ঝাপিয়ে পড়লো সে, আনন্দ আতিশয্যে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আর অবশেষে সেই মূলবান সম্পদ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। এরপর এলো সেই পার্টির দিন। বলতেই হবে মাদাম লোইজেল সেদিন সবাইকে জয় করেছিলেন। তিনিই ছিলেন সেই সন্ধ্যার পার্টির সবচেয়ে সুন্দরী, সেরা আকর্ষণীয়া, হাস্যময়ী নারী। খুশি যেনো তার আর ধরছিলোই না। পুরুষদের সকলেরই আকর্ষণ ছিলো তার প্রতি, তারা তার নাম জানতে চাইছিলো, তার সাথে পরিচিত হতে চাইছিলো। রাজ্যের সকল আন্ডার সেক্রেটারি তার সঙ্গে নাচতে চাইলেন, নাচলেনও। মন্ত্রীরও নজর পড়ে ছিলো তারই ওপর। সে রাতে সে পরমানন্দে পাগলের মতো নেচেছিলো, খুশিতে উন্মাতাল হয়ে উঠেছিলো, কোনও কিছু নিয়েই তার কোনও ভাবনা কাজ করছিলো না, সৌন্দর্য্যের ছটায়, মুগ্ধতার আতিশয্যে, খুশির মেঘমালায় ভেসে ভেসে সে যেনো গোটা দুনিয়া পরিভ্রমণ করছিলো, আর মনের যত ইচ্ছা ছিলো সবগুলোই যেনো পূরণ হয়ে বিজয়ের পরিপুর্ণতায় তার মেয়েলি হৃদয়খানি ভরে উঠছিলো।

ভোর চারটার দিকে পার্টি শেষ হলো তার। সে অবধি স্বামী বেচারা একটি ছোট্ট কক্ষে বসে ঝিমুলেন। সঙ্গে আরও তিনজন ছিলেন যাদের স্ত্রীরাও তখন আমুদে সময় কাটাচ্ছিলেন। ঘরে ফেরার জন্য প্রতিদিনকার পরার একটি কাপড় স্ত্রীর কাঁধে ছুড়ে দিলেন তিনি। বল ড্রেসের সৌন্দর্যের সঙ্গে তা ছিলো একদমই বেমানান। সে ব্যাপারে পুরোই সচেতন ছিলো সে। আর সে কারণেই যাতে দামী পশমী কাপড় পরা অন্য নারীদের চোখ এড়ানো যায় সে জন্য দ্রুত বেরিয়েও এলো। মঁসিয়ে লোইজেল তাকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। “একটু থামো। বাইরে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমি একটা ক্যাব ধরার চেষ্টা করি।” কিন্তু তার কথায় থোরাই পাত্তা দিলো সে। বরং দ্রুতই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। বাইরে গিয়ে তারা কোনও ক্যাবই পাচ্ছিলো না। দূর থেকে যে ক্যাবগুলো দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো ওগুলো উদ্দেশ্যে গলা ফাটিয়েও কোনও লাভ হলো না।তারা ক্রমেই জলাধারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো আর ঠাণ্ডার তীব্রতা ততই বাড়ছিলো। অবশেষে তারা জেটিতে একটি পুরোনো সটক দেখতে পেলো, রাত নামলে এগুলোর দেখা কেবল এই প্যারিসেই মেলে, যেনো ওগুলো তাদের জীর্ণ দশা নিয়ে দিনের আলোয় বেরোতে চায় না। সটকটি র্যু দ্য মার্টারসে ওদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলো, আর ধীরে ধীরে তারা ঢুকে পড়লো নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে। এখন কেবল ঘুমুতে যাওয়া। তবে স্বামীটির সে জো নেই কারণ সকাল দশটার মধ্যেই তাকে অফিসে ঢুকতে হবে। কাধের ওপর পেচিয়ে রাখা সাধারণ পোশাকটি সরিয়ে ফেললো সে, যাতে আয়নায় নিজের ঝলমলে রূপটা আরেকবার দেখতে পায়। কিন্তু তখনই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো চিৎকার। গলায় তার নেই সেই হিরের নেকলেস!

“কি হয়েছে বলো তো?” স্বামীটি বললেন, ততক্ষণে আধেক পোশাক খুলে ফেলেছেন তিনি।

স্বামীর দিকে যখন ফিরলো তখন তার মুখ পুরোই ফ্যাকাশে।

“আমা.. আমা.. আমার কাছেতো মাদাম ফোরেস্তিয়ের নেকলেসটি নেই...।”

“কী বলো!... অসম্ভব কথা!” বিষ্ময়ে হতভম্ভ কন্ঠ স্বামীর।

দুজনে মিলে পোশাকের প্রতিটি পরত উল্টে পাল্টে খুঁজলো তারা। তার নিজের কোটের ভাজগুলো, পকেট গুলোও বাদ রাখলো না। কিন্তু ‍বৃথাই সে খোঁজাখুজি। কিছুই মিললো না।

“তুমি কি নিশ্চিত, আমরা যখন বল নাচ থেকে বের হই তখনও ওটি তোমার গলায় ছিলো?” জানতে চাইলেন তিনি।

“হ্যা মন্ত্রণালয়ের হলে যখন ছিলাম তখনও একবার ছুঁয়ে দেখেছি।”

“কিন্তু রাস্তায় পড়লেতো শব্দ শুনতে পেতাম।”

“হ্যা। তাইতো! তুমি কি ক্যাবের নম্বরটা নিয়েছিলে?”

“না। তুমিওতো নম্বরটা দেখোনি, তাই না?”

“না দেখিনি।”

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, অসহায় দৃষ্টিতে। অবশেষে মসিয়েঁ লোইজেল ফের তার কাপড় পরে নিলেন। “যেই পথটুকু আমরা হেঁটেছিলাম গিয়ে সেখানটুকু খুঁজে দেখি পাই কিনা,” বললেন তিনি। বলেই বেরিয়ে পড়লেন। পার্টির কাপড় পরেই বসে থাকলো সে, বিছানায় যাওয়ার শক্তিও নেই শরীরে। স্রেফ চেয়ারের ওপর ঝিম মেরে বসে থাকলো। আর ভাবনার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে সে। সকাল সাতটা নাগাদ স্বামী ফিরলেন খালি হাতে।

অবশেষে তিনি গেলেন পুলিশ স্টেশনে, এরপর খবরের কাগজগুলোর অফিসে, পেয়ে কেউ ফেরত দিলে পুরস্কার পাবে এই ঘোষণা দিতে গেলেন ক্যাব কোম্পানিগুলোতেও। এভাবে যেখানেই সামান্য আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন তার সবখানটা চষে বেড়ালেন।

এমন পরিস্থিতিতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে তার সবটুকু বিস্বাদ নিয়ে দিনভর অপেক্ষা করলো সে।

রাতে লোইজেল ঘরে ফিরলেন, মুখখানি তার তখনও ফ্যাকাশে। কোনই কুল কিনারা করতে পারেন নি তিনি।

“তোমার বন্ধুকে বিষয়টি লিখে জানানো উচিত,” বললেন তিনি, “তাকে বলো তুমি নেকলেসটির একটি খাঁজ ভেঙ্গে ফেলেছো। সারাইয়ের জন্য দিচ্ছো। তাতে আমরা ওটি খুঁজে বের করার সময় পাবো।”

যেমনটা স্বামী বললেন সেভাবেই একটি চিঠি লিখে পাঠালো সে। এভাবেই গোটা একটা সপ্তাহ কেটে গেলো। আর ততদিনে সব আশার প্রদীপই নিভে গেলো তাদের। লোইজেলের বয়স যেনো পাঁচ বছর বেড়ে গেছে এই ক’দিনে। তিনি বললেন: “আমাদের এই হীরাগুলো কিনে বসিয়ে দিতে হবে।” পরের দিন তারা নেকলেসের বাক্সটি নিয়ে এর গায়ে লেখা নাম ধরে জুয়েলার্সটিতে গেলো। আর দোকানের রেজিস্ট্রার বইগুলো ঘেঁটে দেখলেন তিনি। দোকানি বললেন, মাদাম আমি কিন্তু এই নেকলেস বিক্রি করিনি। আমি স্রেফ খাজগুলো দিয়েছিলাম। এরপর তারা জুয়েলার থেকে জুয়েলারে ঘুরতে লাগলো। স্মৃতিতে যতটুকু রয়েছে তাই দিয়ে মনে করে করে তারা একই রকম আরেকটি নেকলেস খুঁজতে চেষ্টা করলো। প্যালাইজ রয়্যাল নামের দোকানে তারা হীরার একটি অলংকার পেলো যেটি দেখতে ঠিক ওই নেকলেসটির মতো। যা দাম চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ। তবে তারা ৩৬ হাজার ফ্রাঁয় দিতে রাজি।

দোকানিকে তারা তিন দিনের মধ্যে ওটি বিক্রি না করার জন্য অনুরোধ জানালো। আর একমত হলো, যদি ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদও হারিয়ে যাওয়া নেকলেসটি পাওয়া যায় দোকানি পরে ওটি ৩৪ হাজার ফ্রাঁয় ফেরত নেবেন।

পিতার উত্তরাধিকারে লোইজেলের কাছে ছিলো ১৮ হাজার ফ্রাঁ। বাকিটা সে ধার করবে বলেই মনোস্থির করলো। আর ধার করেও ফেললো। এক জনের কাছ থেকে এক হাজার ফ্রাঁ, অারেক জনের কাছ থেকে পাঁচশ’ ফ্রাঁ। এখান থেকে পাঁচ ফ্রাঁ, ওখান থেকে তিন এভাবে। ভয়াবহ সব শর্তে ও চুক্তিতে সে অর্থ কর্য নিলো। তার যা কিছু ছিলো তা আজীবনের জন্য মর্টগেজ দিলো, বুঝে না বুঝে নানা শর্তে সুদে ধার নিলো। ভবিষ্যতে কি কালো অমানিষা তার ওপর নেমে আসতে পারে তা নিয়ে কিছুই ভাবলো না। সকল শারিরীক ও মানসিক যাতনা মেনে নিয়ে যোগাড় করলো ৩৬ হাজার ফ্রাঁ আর তা নিয়ে রাখলো জুয়েলার্সের কাউন্টারে।

এরপর মাদাম লোইজেল যখন মাদাম ফোরেস্তিয়ারের কাছে নেকলেসটি নিয়ে গেলো তিনি ঠাণ্ডা স্বরে বললেন: আরো আগে তোমার এটি নিয়ে আসা উচিত ছিলো। আমার খুব প্রয়োজন ছিলো। জিনিষটা দেখলে সে কি-ই ভাববে? কি-ইবা বলবে তাকে? তাকে চোর ভেবে বসবে না তো? এসব চিন্তাই উথাল-পাথাল খেলে যাচ্ছিলো তার মনে। সে ভয়ে ভয়ে থাকলেও মাদাম ফোরেস্তিয়ার কিন্তু বাক্সটি খুলেও দেখলেন না।

এরপর মাদাম লোইজেল জানলো জীবনে দারিদ্রের কষাঘাত ঠিক কেমন হতে পারে। তবে একে এক সাহসিকতার লড়াই হিসেবেই নিলো সে। ভয়াবহ যে ঋণের বোঝা চেপে বসেছে তা পরিশোধ করাই এখন কাজ। সিদ্ধান্ত নিলো সেই এর ব্যবস্থা করবে। বাড়ির কাজের মেয়েটিকে বিদায় করে দিলো দ্রুত। ফ্ল্যাট ছেড়ে গিয়ে একটি চিলেকোঠায় শুরু হলো বসবাস।

এখন সে বুঝতে পারলো ঘরকন্নার কাজ কতটা ভারী আর কষ্টের, রান্নাঘরে কত কী যে কাজ যা এতদিন সে ঘৃণাই করে এসেছে। থালাবাসন ধোওয়া, কড়াইয়ের তলায় জমে যাওয়া কালি মুছে মুছে তার গোলাপী নোখগুলোর কত বেহাল দশা। এছাড়াও নোংরা কাপড়-চোপড় ধোওয়া-শুকোনো সবই সারছে নিজের হাতে। প্রতিদিন ভোরে, দম চেপে ধরে ময়লার বিন নিজেই বয়ে নিয়ে যায় রাস্তায়। একটু পর পর থেমে দম নিয়ে আবার হাঁটে। আর গরীবি পোশাক পরে, হাতে ঝুড়ি ঝুলিয়ে সে যায় ফলের দোকানে, মুদি, কসাইখানায়। প্রতি হাফপেনি বাঁচাতে দোকানিদের সঙ্গে দরকষাকষি করে, প্রয়োজনে শোরগোল বাঁধিয়ে দেয়।

মাসে মাসেই ঋণের টাকা শোধ করতে হয়, একজনকে শোধ দিলে আরেক জনেরটা শোধ করার সময় এসে যায়।

স্বামীটিও তার সন্ধ্যাবেলায় কাজ নিয়েছে এক ব্যবসায়ীর দোকানে হিসাব-নিকাশ দেখার। এছাড়াও রাতে দলিল দস্তাবেজের নকল লিখে প্রতি পৃষ্ঠায় দুই পেন্স করে পায়।

এভাবেই জীবনের গতিপথে পার হয়ে যায় দশটি বছর।

দশ বছরের মাথায় তাদের সকল ঋণ পরিশোধ হয়ে যায়। সুদ আর তস্য সুদ সবকিছুই শোধ করে দেয় তারা।

মাদাম লোইজেলের চেহারায় তখন বুড়োটে ভাব। ঘর-গৃহস্থালীর অন্য শক্ত-সামর্থ, কঠোর আর গাটগোট্টা নারীদের মতোই চেহারা তারও। চুলগুলো শ্রীহীন, স্কার্টে কোনাকুনি সেলাই, হাত দুটি খসখসে লাল। কণ্ঠে কর্কশ স্বর। চারিদিকে থকথকে কর্দমাক্ত একটা জীবন। তবে, কখনো কখনো যখন স্বামী কাজে থাকেন, তখন জানালার ধারে বসে সেই অনেক দিন আগের সন্ধ্যাটির কথা মনে আসে, সেই বল নাচের কথা যেখানে সেই ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়, তার প্রতিই ছিলো সবার মুগ্ধতা।

সেই রাতে অলংকারগুলো হারিয়ে না ফেললে, জীবনটা কেমন হতে পারতো, কে তা জানে? কেই জানে? জীবন কত অদ্ভুত, কতই না অনিশ্চয়তায় ভরা! কত সামান্যতেই জীবন ধ্বংস হয়ে যায়, আবার রক্ষাও পায়। এমনসব আকাশ পাতাল ভাবনা তার।

কোনও এক রবিবারে গোটা সপ্তাহের খাটুনিতে ক্লান্ত সে চ্যাম্প ইলিসিসের দিকে ঘুরতে গেলো একটু মনটাকে চাঙ্গা করে নেবে বলে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার চোখ পড়লো এক নারীর ওপর, ফুটপাতে একটি শিশুর সঙ্গে কথা বলছেন। উনি ছিলেন মাদাম ফোরেস্তিয়ার। এখন বেশ যুবতী, সুন্দরী আর আকর্ষণীয়া।

এত কিছুর পরেও কিছু কিছু অনুভূতির বিষয়ে এখনও বেশ সজাগ মাদাম লোইজেল। হ্যাঁ অবশ্যই। আর এখনতো সব দেনাই তার শোধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেনো নয়?

এগিয়ে গেলো সে তার দিকে।

“সুপ্রভাত, জিনি।” অন্যজন তাকে চিনতে পারলেন না। আর এমন এক দরিদ্র চেহারার নারীর মুখে সরাসরি নিজের নামে সম্ভাষণ শুনে বিষ্মিতও হলেন। “কিন্তু... মাদাম.....” তোতলাচ্ছিলেন তিনি। “আমি ঠিক চিনলাম না.... আপনি নিশ্চয়ই কোনও ভুল করছেন।” “নারে... আমি মাথিলদে লোইজেল।” শুনে তার বান্ধবী চিৎকার করে উঠলেন। “ওহ!... আমার বেচারী মাথিলদে, এ কী দশা তোমার। কিভাবে বদলে গেছো তুমি!....”

“হ্যাঁ... তোমার সঙ্গে সেই শেষ দেখার পর এক কঠিন সময় আমি পার করেছি। অনেক দুঃখ কষ্টে গেছে আমার দিন... আর তার সবটাই তোমার কারণে।” “আমার কারণে!... সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“তোমার সেই হীরার নেকলেসটির কথা মনে আছে। সেই যে ধার নিয়েছিলাম মন্ত্রণালয়ের বল নাচের অনুষ্ঠানে পরবো বলে?” “হ্যাঁ, ভালোই মনে আছে।”

“বেশ! তাহলে শোনো, সেদিন আমি তোমার নেকলেসটি হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

“সেটা কী কথা? আর তাই যদি হয়, তাহলে সেটা ফেরত দিলেই কী করে?”

“আমি তোমাকে ঠিক একই রকমের আরেকটি হীরার নেকলেস কিনে দিয়েছি। আর গত দশটি বছর ধরে আমি কেবল সেই দেনা শোধ করেছি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারো আমাদের জন্য কাজটি সহজ ছিলো না। আমাদের কাছে কোনই অর্থ ছিলো না...। যাই হোক, অবশেষে সব দেনা শোধ হয়েছে। এখন আমি বেশ খুশি।” হতবাক হয়ে থাকলেন মাদাম ফোরেস্তিয়ার।“ তুমি বলছো আমার হারিয়ে যাওয়া নেকলেসটির বদলে তুমি একটি হীরার নেকলেস কিনেছো?”

“হ্যাঁ। কেনো তুমি ওটা দ্যাখোনি? অনেকটাই একই রকম দেখতে হয়েছে।”

কথাটি বলে, গর্ব আর নির্দোষ আনন্দের হাসি হাসলো সে।

মাদাম ফোরেস্তিয়ার ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। তিনি দুই হাতে তুলে নিলেন তার দুটি হাত।

“ওহ! আমার হতভাগী মাথিলদে! আমার নেকলেসটিতো ছিলো স্রেফ নকল। ওর দাম ছিলো বড় জোর পাঁচ শ’ ফ্রাঁ...”


গল্পটির মূলভাব ও শিক্ষাঃ

বিশ্ববিখ্যাত গল্পকার গী দ্য মোপাসাঁর রচিত ‘নেকলেস’ বিপুল জনপ্রিয় একটি গল্প। বেপরোয়া স্বপ্ন দেখা এক নারীর স্বপ্নকে সার্থক করার পরিণাম এ গল্পে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করে কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষের জন্য সর্বনাশের কারণ হয়ে ওঠে। মাদাম লোইসেলের বেপরোয়া স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নকে সার্থক করার জন্য স্বামীর শখের বিসর্জন, নেকলেসকে কেন্দ্র করে এই দম্পতির জীবনমানের অসচ্ছল অবস্থা, মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে মাদাম লোইসেলের শারীরিক সৌন্দর্যের অবনতি, ঋণ শোধ করার পর বান্ধবী ফোরস্টিয়ারের কাছে গর্বের সঙ্গে যাবতীয় ঘটনা বলার মাধ্যমে নিজেকে মর্যাদাশালী করার চেষ্টা। একটু অসাবধানতা জীবনে কীরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। জীবনের দশটি বছর ব্যয় করে একটি নেকলেসের মূল্য জোগাতে গিয়ে তাদের সুখ-শান্তি সবই বিসর্জন দিতে হয়েছে। অপ্রত্যাশিত কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় সমাপ্তির মাধ্যমে গল্পটি সমাজ জীবনের একটি শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরেছে।